২০১৩ সালে ঐতিহাসিক শাপলা চত্বরে মর্মান্তিকভাবে অসংখ্য আলেমকে শহীদ করার পর খুনি জিয়াউল আহসান গংরা ভারতের উস্কানিতে কোটি কোটি রূপির ফান্ড দ্বারা বাংলাদেশের নিরীহ বহু আলেমকে গ্রেফতার করার জন্য এক ভয়াবহ নাটক করেছিল। জামালপুর নিবাসী মাওলানা আবুল কালাম চট্টগ্রাম লালখান বাজার জামিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়্যাহ মাদ্রাসার একজন প্রাক্তন নিরীহ মেধাবী ছাত্র ছিল। বেচারা সে কারাবন্দি নিরীহ আলেমদের মুক্তির জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির করত। তার শ্বশুর হলেন কক্সবাজারের পুকখালীর একটি বড় কওমী মাদ্রাসার মুহতামিম। তিনি হজ্ব থেকে ফিরবেন সেই সুবাদে কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য সে আমার নিকট এসে বললো, ‘হুজুর! আমি ঢাকায় যাবো, আপনি দয়া করে আমাকে কিছু গাড়ি ভাড়া দিন।’ আমি তাকে মাত্র ৫০০ টাকা দিয়েছিলাম। সেই অল্প টাকায় ঐ বেচারা ঢাকা পৌঁছতে পেরেছে কিনা, তা অবগত হওয়ার জন্য তাকে মোবাইলে কল করলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় আমি চরমভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ি এবং আমি অব্যাহতভাবে টানা চার-পাঁচদিন ধরে তার সকল আত্মীয়-স্বজনকে কল করি। পাঁচ-সাতদিন পর আমাকে মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বললেন, ‘হুজুর! আপনার মাওলানা আবুল কালামসহ পাঁচ-সাতজন আলেম বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখাচ্ছে। তারা নাকি রাউজানের গভীর পাহাড়ি জঙ্গলে বোমা তৈরি করেছিলেন। র্যাব-৭ এর সাবেক কর্মকর্তাগণ তাদের ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করে রাউজান থানায় পেশ করেন।’ রাউজান থানার দুইজন ওসির মধ্যে একজন ওসি আমাকে টেলিফোনে বললেন, ‘হুজুর! আপনার ভক্ত সাতজন আলেমে দ্বীন র্যাব-৭ এর হাতে বন্দি হয়ে রাউজান থানায় অবস্থান করছেন।’ আমি ওসিকে বললাম, ‘তারা সবাই অত্যন্ত নিরীহ ও দরিদ্র আলেমে দ্বীন। তাদের মধ্যে মাওলানা আবুল কালাম আমার নিকট থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার পর তার কাছে না আছে রিক্সা ভাড়া আর না আছে পানাহারের কোনো টাকা-পয়সা। এমতাবস্থায়, তারা কীভাবে বোমা ও অস্ত্র তৈরি করতে রাউজানের গভীর পাহাড়ি জঙ্গলে পৌঁছলেন, তা বিবেকবান সকল বিশ্ববাসীর জন্য একটি প্রশ্ন! এটা উলামায়ে কেরাম নিধনের ভয়ংকর ভারতীয় পরিকল্পনায় সাজানো এক জঙ্গি নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়।’
রাউজানের ওসি আমাকে কল করার কারণে র্যাব-৭ এর এসপি আমাকে লালখান বাজার মাদ্রাসায় এসে বললেন যে, র্যাব-৭ এর অধিনায়ক ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল সাজ্জাদ আপনাকে স্মরণ করেছেন। আমি উত্তরে বললাম, ‘তার সাথে সাক্ষাতের জন্য আজ আমার সময় হবে না। আমি আগামীকাল তার সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করবো। আপনি আমাকে ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল সাজ্জাদের টেলিফোন নাম্বার দিন।’ উত্তরে এসপি বললেন, ‘স্যারের অনুমতি ছাড়া আমি আপনাকে তাঁর টেলিফোন নাম্বার দিতে পারবো না।’ আমি এসপিকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘কেন র্যাব-৭ এর অধিনায়কের নাম্বার দেয়া যাবে না? র্যাব মহাপরিচালকসহ যে কোনো সরাসরি ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাকে আমি টেলিফোন করে দেখাবো কি?’ তখন এসপি আমাকে ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল সাজ্জাদের টেলিফোন নাম্বার দিলে আমি তাকে বললাম, ‘ভাই! আমি আপনার অফিসে আজ আসতে পারবো না। আগামীকাল আসার চেষ্টা করবো।’ আসলে র্যাব- কর্তৃক নিরীহ উলামায়ে কেরামকে জঙ্গি সাজিয়ে ভারতের রূপি খাওয়া ছাড়া এখানে আর অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।
সেজন্য এমন ভয়াবহ মানবিক দুর্ঘটনার পরিস্থিতিতে ঐ সাতজন আলেমের অভিভাবকগণ থেকে তাদের নিখোঁজ হওয়ার জিডি কপি সংগ্রহ করে আমি আমার লালখান বাজার মাদ্রাসার অফিস কক্ষে তৎকালীন সময়ে খুনি জিয়াউল আহসানের স্বরূপ উন্মোচন করার জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করি।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক আমার সংবাদ সম্মেলনের কথা শুনে প্রায় দুই-তিনহাজার নারী-পুরুষ র্যাব বাহিনী দিয়ে আমার মাদ্রাসা ক্যাম্পাস ঘেরাও করে আমাকে আমার বাসভবন থেকে বিকাল তিনটায় গ্রেফতার করে। পতেঙ্গাস্থ র্যাব-৭ এর হেড কোয়ার্টারে রাত একটার সময় ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল সাজ্জাদ আমাকে বলেন, ‘হুজুর! আপনি আমাদেরকে সংবাদ সম্মেলন করে বাঁশ দিয়েছেন। তাই আমরা আপনাকে ছাড়তে পারবো না। আপনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবো।’ এরপর তিনি একজন র্যাব- কর্মকর্তাকে ডেকে বললেন, ‘আমরা র্যাব-৭ এর নয়জন কর্মকর্তা আল্লামা মুফতি মুহাম্মাদ ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর গ্রেফতারের বিষয়ে ঢাকার র্যাব-৭ হেড কোয়ার্টারকে ব্রিফিং করার জন্য আমরা নয়জন ঢাকা যাবো। তোমরা নয়টি টিকেটের ব্যবস্থা করো।’ (আসলে র্যাব-৭ হেড কোয়ার্টারে আমার গ্রেফতারের ব্যাপারে ব্রিফিংয়ের নামে ভারতীয় রূপির একটি মোটা অংক নেয়ার জন্য ফন্দি ছাড়া আর কিছুই নয়।)
এভাবে সাতজন নিরীহ ও দরিদ্র আলেমের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আমাকে চট্টগ্রাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে। আমার বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন করলে তা বারবার প্রত্যাখ্যান হয়ে একমাস অতিবাহিত হয়ে যায়। পরে একজন হিন্দু ম্যাজিস্ট্রেট, একজন হিন্দু পিপি এবং আরেকজন হিন্দু উকিল দ্বারা আমার বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন করা হলে ম্যাজিস্ট্রেট আমার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সেই একদিনের রিমান্ডে আমাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকাস্থ র্যাব-৭ হেড কোয়ার্টারে চোখে কালো পট্টি ও হাতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় র্যাব-৭ হেড কোয়ার্টারে হাজির করা হয়। রিমান্ডের নামে প্রথমদিন আমাকে জানালার সাথে দুই হাত পেছনে দিয়ে ২৪ ঘণ্টা বেঁধে রাখা হয়। পরদিন ডিসেম্বর মাসের শীতের রাতে একটি পাতলা কম্বল দিয়ে আমাকে ফ্লোরে শুতে দেয়া হয়। এভাবে এক দিনের রিমান্ডের স্থলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় খুনি জিয়াউল আহসান আমার হাত-পায়ের বিশ আঙুলে ইলেকট্রিক শক দ্বারা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সুঁই বিদ্ধ করতেন। হে বিশ্বের মানবতা! পঞ্চমদিন আমাকে খুন করার জন্য আমার শরীরে খুনি জিয়াউল আহসান নিজ হাতে বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করেন। ঐ বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করার পর র্যাব-৭ হেড কোয়ার্টারে আমার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মতো আশংকা সৃষ্টি হয়। এরপর আমি হাইকোর্টের জামিনে মুক্ত হয়ে লালখান বাজার মাদ্রাসার বাসভবনে আমাকে নিয়ে আসা হলে আমি ঘনঘন বেহুঁশ হয়ে পড়তাম। আমার হুঁশ ফিরে আসলে পরিবারের সদস্যদেরকে বলতাম, ‘আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। তোমরা আমার জন্য কবর খনন কর।’ এমতাবস্থায়, একদিন সকালে ফজরের নামাজের পর কয়েকজন ব্যক্তি আমাকে খুব মুমূর্ষু অবস্থায় বিছানায় শুইয়ে দিলে আমি স্বপ্নে দেখলাম, একজন বুজুর্গ আলেমে দ্বীন আমার বুকে তিনটি ফুঁক দিলে আমি সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ি এবং মহান আল্লাহ তাআলার অপরিসীম কুদরতের কারণে (রাখে আল্লাহ মারে কে) আমি সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে বসে পড়ি।
বিশ্বের অন্যতম মহান আল্লাহ তাআলার সম্মানিত অলি, উম্মতের কুতুব ও আবদাল হযরত শায়খূল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া (রহিমাহুল্লাহ)-এর চট্টগ্রামস্থ শীর্ষ খলিফা হযরত মাওলানা যুবায়ের চাটগাঁমী আমাকে দেখতে আসলে আমি হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হুজুর! যার তিনটি ফুঁকে আমি মৃতপ্রায় ব্যক্তি জীবিত হয়ে উঠলাম, উনি কে?’ হুজুর বললেন, ‘উনি হযরত খিজির আলাইহিস সালাম।’ পরিশেষে আমি কর্নেল জিয়াউল আহসানসহ র্যাবের সংশ্লিষ্ট অফিসার যারা মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করেছিল তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।