৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ১৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ছাত্রলীগের নির্যাতনের ঘটনা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এ নিয়ে একে একে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মুখ খুলছেন। তেমনই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৮-২০০৯ সেশনের শিক্ষার্থী মো. রাকিবুল ইসলাম। পাশাপাশি তিনি ছিলেন সেই সময়কার হল শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি।
২০১৩ সালে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এই শিক্ষার্থীকে ছাত্রশিবির সন্দেহে বেধড়ক মারধর করেন। শুধু তাই নয়, বেধড়ক মারধর করে ফেলে দেওয়া হয় হলের চারতলা থেকে। এ ঘটনায় তার দুই পা ভেঙে ১৩ টুকরা হয়েছিল। সেমময় ছাত্রলীগের নির্যাতনের মাত্রা এতো বেশি ছিল যে, নির্যাতনের পর পানির পিপাসা লাগলে তিনি পানি চাইলে তারা তাদের প্রস্রাব বোতলে করে নিয়ে এসে বলে, ‘এই নে পানি না প্রস্রাব খা।’ সেই নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করা এই শিক্ষার্থী ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। ছাত্রলীগের নির্যাতনে পঙ্গু হওয়া শরীরটা নিয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছি। দেশে ও দেশের বাইরে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু কোন সমাধান হয়নি।
২০১৩ সালের এই ঘটনার বিস্তারিত লেখে ফেসবুকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নৃশংসতা, স্বপ্ন ও পঙ্গুত্ব’ একটি পোস্ট দেন ভুক্তভোগী রাকিবুল। পরে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন তিনি।
ঘটনা কিভাবে শুরু সেই কথা উল্লেখ করে পোস্টের শুরুতে রাকিবুল লেখেন, ২০১৩ সালের ১০ ফ্রেব্রুয়ারি, আসর নামাজের পর আনুমানিক বিকাল ৫টার সময় আমি মুহসীন হলে নিজ রুমে (৫৫৫ নম্বর) পড়াশোনা করছিলাম। হঠাৎ হেলাল উদ্দিন সুমন আমার রুমে আসে এবং জানায় যে, গোলাম রসুল বিপ্লব আমাকে তার রুমে (৪৬২ নম্বর) ডেকেছে। সুমন আমার জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তার কথার মধ্যে বেয়াদবি ও উগ্রতা ছিল। আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে আবু জাহিদ রিপন, জাহিদুল ইসলাম, আহসান হাবিব রানা ও হেলাল উদ্দিন সুমন আমার রুমে আসে। ওরা সবাই মিলে আমাকে রুম থেকে টেনেহিঁচড়ে ৪৬২নং রুমে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় জড়িত যেসব ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নাম এসেছে
‘‘সেখানে আমি জহিরুল ইসলাম ওরফে সরকার জহির রায়হান ও দেওয়ান বদরুল হাসান তুষারদের দেখতে পাই। আবু জাহিদ রিপন আমার মোবাইল নিয়ে বলে, তুই তো শিবির করিস। এই বলে সে আমার মোবাইল চেক করে। এরপর বলে যে, তুই তো হলের সভাপতি। তুই অনেক চালাক। সেজন্য তোর মোবাইল এ কিছু নাই। একথা বলার পরই আবু জাহিদ রিপন আমাকে থাপ্পড় ও ঘুসি মারা শুরু করে। সাথে সাথে মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, জাহিদুল ইসলাম, আহসান হাবিব রানা ও হেলাল উদ্দিন সুমন আমার উপর বর্বর ও হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ে ও আমার মুখে, বুকে ও পিঠে লাথি মারতে শুরু করে।’’
এসময় অমানবিক কায়দায় ছাত্রলীগ নির্যাতন শুরু করে উল্লেখ করে তিনি লেখেন, তারা আমার উপর অত্যাচার শুরু করে। আমি ফ্লোরে পড়ে গেলে ওরা রুমে থাকা লাঠি, রড, লোহার পাইপ, ব্যায়াম সামগ্রী বের করে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অনবরত পিটাতে থাকে। আমাকে মারায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, আবু জাহিদ রিপন ও জাহিদুল ইসলাম। তাদের অত্যাচারে পিপাসার্ত ও দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে আমি পানি চাইলে ওরা তাদের প্রস্রাব বোতলে করে নিয়ে এসে বলে, এই নে পানি না প্রস্রাব খা।
‘‘ধারাবাহিকভাবে মেরে ক্লান্ত হয়ে গেলে ওরা আমাকে ৪ তলার ৪৬২ নম্বর রুমের জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় (উল্লেখ্য রুমের জানালায় কোন গ্রিল ছিল না)। উপর থেকে পড়ে আমার দুই পা ভেঙে ১৩ টুকরা হয়ে যায়। আমার দুটো পা মাটিতে দেবে যায়। আহত অবস্থায় আমি ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে কোনোরকম হাঁটতে হাঁটতে (হাঁটুতে ও হাতে ভর করে) রেজিস্ট্রার ভবনের কাছে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়ির নিচে আশ্রয় নেই (উল্লেখ্য ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে শাহবাগ মোড়ে শুরু হয়ে অব্যাহত থাকা গণজাগরণ মঞ্চের কারণে ক্যাম্পাসে কোন রিকশা বা যানবাহন ছিল না)। মেহেদী হাসান, গোলাম রসুল বিপ্লব, আবু জাহিদ রিপন, দেওয়ান বদরুল হাসান তুষার ও জাহিদুল ইসলাম আমার খোঁজ পেয়ে দ্রুত রেজিস্ট্রার ভবনে আসে এবং ওখান থেকে আমাকে টেনেহিঁচড়ে বস্তার মত করে রিকশায় তুলে ফের হলে নিয়ে যায়।’’
হলের হাউজ টিউটররা ঘটনার সময় বাঁধা দিলে তাদের সঙ্গেও ছাত্রলীগ খারাপ আচরণ করে তিনি বলেন, হলের হাউজ টিউটরবৃন্দ বাঁধা প্রদান করলে তারা তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। ওরা আমাকে আবার ৪৬২ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। সেখানে রানা, মেহেদী, রিপন, বিপ্লব ও জাহিদ আমাকে আবার মারতে শুরু করে। পরবর্তীতে ওরা আমাকে ধরে হল প্রোভোস্ট এর রুমে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় সিঁড়ির সাথে আমার মাথা বাড়ি দেয়। আমার সেন্স কিছুটা কার্যকর হওয়ার কারণে হাত দিয়ে তখন রক্ষা পাই। সেখানে রানা, মেহেদী, রিপন, বিপ্লব ও জাহিদদের সাথে এবি সিদ্দিক রাহাত যোগ দেয় এবং লাঠি-রড দিয়ে আমার মাথায়, পিঠে, বুকেসহ সমস্ত শরীরে আঘাত করে। রাহাত আমার বুকের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে গালিগালাজ করে। এশার আজান দেয়া পর্যন্ত সবাই মিলে এভাবে নির্যাতন করতে থাকে। আমি তো ভেবেছিলাম এ জীবনের হয়ত আর বাবা-মাকে দেখতে পারব না।
‘‘পরিবারের সদস্য ও ভাই-বোনদের মুখগুলো বারবার আমার চোখে ভাসতে ছিল। এ কেমন নির্যাতন। ওরা আমাকে প্রথম পর্যায়ে মেরে রুমের জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। তখনই তো আমি পঙ্গু প্রায়। ভেবেছিলাম এ যাত্রায় হয়ত বেঁচে যাব। একটা ছেলেকে পঙ্গু করেও ওরা ছাড়লো না।আবার হলে এনে ইচ্ছামতো মারল। বিশ্বাস করেন, আমার শরীরটা আর নিতে পারছিল না।’’
এ ঘটনার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমরা অভিভাবক ভাবি। অথচ দেখেন তারা আমার সাথে কেমন আচরণ করল! হল প্রভোস্ট আলী আক্কাস ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর এ এম আমজাদ আমার নির্যাতনের খবর পাওয়া সত্ত্বেও আমি ও অন্য দুই ভিকটিমদের বাঁচাতে তারা কোন ব্যবস্থা নেয় নি। বরং ওদের নির্বিঘ্নে নির্যাতনের সুযোগ করে দিয়েছে। ওরা নিযার্তন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পুলিশ ডেকে পুলিশের গাড়িতে আমাকে তুলে দেয়। তখন পুলিশ আমার অবস্থা বেশি একটা ভালো না দেখে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা যায় আমার উভয় পা বিভিন্ন স্থানে ভেঙে ১৩ টুকরা হয়ে গিয়েছে। এতটা নির্যাতনের পরেও ওদের অত্যাচার ও জীবন নাশের হুমকির কারণে আমি পরবর্তীতে একাডেমিক ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি।
‘‘আমার নির্যাতিত হওয়ার খবর পেয়ে আমার আম্মা ফিরোজা বেগম ও দুলাভাই জাকির হোসেন খান আমাকে ছাড়ানোর জন্য প্রক্টর এ এম আমজাদ এর কাছে যায়। সে তখন বলে যে, এই ছেলে অনেক বড় নেতা তাকে ছাড়া হবে না। আমার মা ও ভাইদের সাথে প্রক্টর আমজাদ অনেক খারাপ ব্যবহার করে। ওদের অত্যাচারে আমি মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। অদ্যাবধি আমি ওদের আঘাতের ফলে শারীরিক ক্ষতি বয়ে বেড়াচ্ছি।’’
এ ঘটনার পর পঙ্গুত্ববরণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওদের নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে আমি আমার সন্তানকে কোলে নিতে পারি না। দুনিয়াতে বাবা হিসেবে এর চেয়ে বড় কষ্ট কি হতে পারে বলেন। ওরা আমার সন্তানের হক কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, আমি এখনো কোনোকিছু ঠিকমতো ধরতে পারি না, ভালোভাবে দাঁড়িয়ে-বসে নামাজ পড়তে পারি না। সিঁড়িতে উঠতে কষ্ট হয়, কোন ধরনের চাপ নিতে পারি না, রোদে গেলে মাথা ও দাঁতে ভীষণ জ্বালাপোড়া করে, রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না, প্রায়ই ঘুমের মধ্যে ওইদিনের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। প্রায়ই হঠাৎ বমি হতে থাকে এবং স্বাভাবিক চলাফেরা বা বসতে পারি না। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সকল অঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ব্যথা এবং কষ্ট অনুভব হয়।
সবশেষে সবার কাছে দোয়া চেয়ে তিনি পোস্টে বলেন, দেশে ও দেশের বাইরে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু কোন সমাধান হয়নি। এখনো ছাত্রলীগের নির্যাতনে পঙ্গু হওয়া শরীরটা নিয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছি। এই আশায় যে আমি ভালোভাবে দাঁড়িয়ে-বসে নামাজ পড়তে পারব ও আমার সন্তানকে একটু ভালো করে কোলে নিতে পারব। সমাজে একটু স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারব। জানি না মহান মনিব তার আশ-শাফি (রোগ নিরাময়কারী) নামের উসিলায় আমার প্রতি রহম করবেন কি না।